স্টাফ রিপোর্টার,উত্তরবঙ্গ প্রতিদিন ::- লাল কলম, কালির বোতল, কাগজের স্তূপ– আপনি যদি দৈনিক ‘দি মুসলমান’ পত্রিকার অফিসে প্রবেশ করেন, তাহলে আপনার চোখে এই চিত্রটিই ভেসে উঠবে। কম্পিউটারের ব্যবহার বর্জিত, হাতে লেখা এই পত্রিকার বয়স এখন ৯১ বছর। সম্ভবত এটাই বিশ্বের একমাত্র হাতে লেখা ও কম্পিউটারের ব্যবহার বর্জিত সংবাদপত্র। ফলে এই ঐতিহ্যবাহী পত্রিকাটি এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পত্রিকাটির অফিস ভারতের চেন্নাইয়ে। একটি গাঢ় সবুজ ভিজিটিং কার্ড– যেখানে পত্রিকার সম্পাদকের নাম দেয়া আছে। সম্পাদকের নাম সাইয়েদ আরিফুল্লাহ। কার্ডে তার অর্জিত ১৩টি ডিগ্রির তালিকাও উল্লেখ করা আছে। আরিফুল্লার বয়স এখন ৩০ বছর। প্রায় ১০ বছর যাবত তিনি এই পত্রিকাটির হাল ধরে রেখেছেন।
দি মুসলমান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৭ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আরিফুল্লার দাদা সাইয়েদ আজাতুল্লাহ। তিনি তখন অনুভব করেন যে, মুসলমানদের কথা তুলে ধরার জন্য কোন সংবাদপত্র নেই, তাই একটি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠা করা উচিৎ।
চেন্নাইয়ের বিখ্যাত অয়ালাজাহ মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট লেনের মধ্যে পত্রিকাটির অফিস। অফিসে দুই রুমের অপর্যাপ্ত জায়গা– একটিতে প্রেস ও অন্যটিতে অভ্যর্থনা কক্ষ। দি হিন্দু পত্রিকার সাংবাদিককে আরিফুল্লাহ বলেন, ‘আমরা জায়গার অপ্রতুলতার বিষয়টি নিয়ে ভাবছি, অতএব শীগ্রই বিষয়টি সমাধান হবে’।
শুরু থেকে এ পর্যন্ত পত্রিকাটির তিন জন সম্পাদক ছিলেন, সাইয়েদ আজাতুল্লাহ, তার পুত্র সাইয়েদ ফাজলুল্লাহ এবং বর্তমানে সাইয়েদ আরিফুল্লাহ। আমি জানতে চাইলাম, তিনি কি তার পিতার কাছ থেকে এই দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন, জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা সবসময়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, পত্রিকাটি চালু রাখতে হবে, সুতরাং আমি এটা করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি সম্পাদনা করি, আমি লেখি, সর্বোপরি পত্রিকাটি এখন পর্যন্ত চালু রেখেছি’।
চার পৃষ্ঠার এই পত্রিকাটির প্রায় সব খবর ও লেখা আরিফুল্লাহ নিজে বাছাই করেন। তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের রিপোর্টার রয়েছে, তবে ‘দি ইকনোমিস্ট’-এর মত তারাও পত্রিকায় তাদের কোন প্রতিবেদকের নাম উল্লেখ করেন না।
প্রতিদিন সকাল ১০টার দিকে দুইজন অনুবাদক অফিসে আসেন, যারা এই সংবাদকে উর্দু ভাষায় অনুবাদ করেন। দুই ঘন্টা পরে তিনজন ক্যালিগ্রাফার পত্রিকার ক্যালিগ্রাফি শুরু করেন, এদেরকে ‘কাতিব’ বলা হয়। তারা ক্যালিগ্রাফিক কলমের মাধ্যমে প্রত্যেকটি সংবাদ পত্রিকার কাগজে লিপিবদ্ধ করেন।
সত্যিকার অর্থে ক্যালিগ্রাফিই পত্রিকাটির মূল প্রাণ। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে ‘কাতিব’ তথা যারা আগে উর্দু সংবাদপত্রে ও প্রকাশনায় চাকরি করতেন, তাদের সংখ্যা দিনকে দিন হ্রাস পাচ্ছে। এই শিল্পের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে শ্রীনগর, যেটি সর্বশেষ উর্দু ক্যালিগ্রাফি শিক্ষা দেয়ার সরকারি প্রতিষ্ঠান, সেখানেও গত মে মাসে শুরু হওয়া কোর্সে কোন আগ্রহী ব্যক্তি বা প্রশিক্ষাণার্থী পাওয়া যায়নি।
আরিফুল্লাহ স্বীকার করেন যে, লেখার জন্য অভিজ্ঞ লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে তিনি জানান, তিনি এখনও এই সমস্যার মুখোমুখি হননি। তার লেখকরা এখানে গত ৩০ বছর যাবত কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘তৎকালীন সময়ে, আমার পিতা একটি ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন, তিনি তাদের হাতের লেখা যাচাই করেন, এবং তাদেরকে বাছাই করে কাজে নিযুক্ত করেন। তারা সেই থেকে আমাদের সাথে আছেন– আমরা এখন একটি পরিবারের মত’।যখন লেখার কাজ শেষ হয়, তখন বিজ্ঞাপনগুলি সংযুক্ত করা হয় এবং পত্রিকাটি প্রিন্টের জন্য নেগেটিভে স্থাপন করা হয়।
প্রায় দুপর ১টার দিকে পত্রিকার প্রিন্ট শুরু হয় এবং সন্ধ্যা নাগাত প্রায় ২১,০০০ পাঠকের কাছে পত্রিকাটি পৌঁছে যায়। পত্রিকাটির দাম মাত্র ৭৫ পয়সা। আরিফুল্লাহ বলেন, ‘এটা ভারতের সবচেয়ে কম দামের পত্রিকা!’ তিনি একটু মজা করে বলেন যে, পত্রিকা থেকে আমার কোন আয় হয় না, আমার আয় হয় প্রেস ব্যবসা থেকে।
সম্পাদক বলেন, ‘আমরা জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয়সহ প্রায় সকল প্রকার সংবাদ পরিবেশন করে থাকি’। মিশরের নির্বাচন থেকে শুরু করে ‘কারসিনোজেনিক’ কফি– দি মুসলমান সবকিছুই প্রকাশ করে। তবে অধিকাংশ উর্দু সংবাদপত্রের মত দি মুসলমানও সংবাদ প্রকাশের চেয়ে ‘মতামত’ প্রকাশকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও উর্দু পত্রিকাটির ভক্ত শামসুর রেহমান আলাভি বলেন, ‘আমাদের দেশের উর্দু সংবাদপত্রের আয় প্রায়ই কমে যায়, ফলে তারা ব্রেকিং নিউজ তুলে ধরতে পারে না বা এজেন্সিদের টাকা পরিশোধ করতে পারে না, ফলে তারা মতামত ও প্রাসঙ্গিক সংবাদ প্রকাশে বেশি গুরুত্বারোপ করে থাকে’।
আরিফুল্লাহ তার সাথে একমত পোষণ করে বলেন, ‘আমরা ব্রেকিং নিউজ পরিবেশন করি না। পত্রিকার সব পৃষ্ঠা মিলিয়েও তা প্রকাশ দুঃসাধ্য, ফলে আমরা এটা বাদ দিয়ে দিয়েছি’।
তিনি আরও বলেন, আমরা সমাজের সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ‘নিঃসন্দেহে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বের জায়গা হচ্ছে ইসলাম ও ইসলামের শিক্ষাকে তুলে ধরে, কিন্তু এটাই আমাদের সব নয়’।
আরিফুল্লাহ জানান, সারা দেশজুড়ে পত্রিকাটির পাঠক রয়েছে। ‘দিল্লি, কোলকাতার… অনেক পরিবার রয়েছে, যারা বংশপরম্পরায় পত্রিকাটির গ্রাহক। আমরা তাদেরকে কুরিয়ারের মাধ্যমে পত্রিকা প্রেরণ করে থাকি’।
সংবাদপত্রটিতে বেশ কিছু বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় জুয়েলারি, ফার্নিচার, ভ্রমণ সংস্থা, এমনকি কিছু সরকারি টেন্ডারেরও বিজ্ঞাপন তারা পেয়ে থাকে।
পত্রিকাটির প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনাম ও গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রকাশ করা হয়। দ্বিতীয় পাতায় সম্পাদকীয় এবং বাকি দুই পৃষ্ঠায় স্থানীয় সংবাদ ও বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। সোমবারের সংখ্যা একটু ভিন্নধর্মী হয়ে থাকে– এদিন কুরআন ও ইসলামী ইতিহাস নিয়ে অধিক নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়।
স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে, উত্তর ভারতে অনেকগুলি বিখ্যাত উর্দু পত্রিকা চালু ছিল এবং তা সবাই ব্যাপক পরিসরে পঠিত হত, বিশেষত ধর্মীয় বিবেচনায়। কিন্তু দেশভাগের পরে উর্দু পত্রিকার ভাগ্য খারাপ হয়ে যায় এবং অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।
গত এক দশকে এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষত ‘সাহারা’(নতুন নাম রোজনামা সাহারা) ও ইনকিলাবের মত পত্রিকার পুনরুত্থান ঘটেছে।
অন্যান্য পত্রিকাও সম্ভবত অনলাইনে যাবে, কিন্তু দি মুসলমান নিয়ে সে ধরণের কোন পরিকল্পনা নেই। আরিফুল্লাহর মতে, এই পত্রিকার বিশেষত্বই হচ্ছে, এটা হাতে লেখা পত্রিকা, অন্য কোন ধরনের পদক্ষেপ পত্রিকাটির ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করবে।
গত ৯১ বছরের প্রত্যেকটি দিন পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছে, এমনকি দেশভাগের সময়েও দি মুসলমান চালু ছিল। সুতরাং এর পরে কী ঘটবে? আরিফুল্লার সন্তান এই উত্তারাধিকার বহন করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে ? এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফুল্লাহ হাসি দিয়ে বলেন, ‘অবশ্যই’। ‘যদিও তার বয়স এখন মাত্র ৫ বছর, তবে আমরা চাই ভবিষ্যতে সে এটাই করুক’।
Uttorbongo Protidin most google ranking bengali news portal from Bangladesh.
Discover more from UttorbongoProtidin.Com 24/7 Bengali and English National Newsportal from Bangladesh.
Subscribe to get the latest posts sent to your email.