
আন্তর্জাতিক সংবাদ || উত্তরবঙ্গ প্রতিদিন :: নেপালে জেন জি নেতৃত্বাধীন আন্দোলন, যা প্রাথমিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল, দ্রুত সরকার বিরোধী এবং দুর্নীতি বিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নিয়েছে, যা সহিংসতা ও অশান্তির মাধ্যমে কাঠমাণ্ডুসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এই আন্দোলনের ফলে গুরুতর ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঝলানাথ খনালের স্ত্রী রাজ্যলক্ষ্মী ছবিকার নিহত হওয়া এবং প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির পদত্যাগ ঘোষণা অন্যতম।
ঘটনার বিবরণ: রাজ্যলক্ষ্মী ছবিকার মৃত্যু:
মঙ্গলবার কাঠমাণ্ডুর দাল্লু এলাকায় আন্দোলনকারীরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঝলানাথ খনালের বাড়ি ঘেরাও করে এবং অগ্নিসংযোগ করে। এতে দগ্ধ হয়ে রাজ্যলক্ষ্মী ছবিকা মারা যান। পরিবারের সূত্র জানায়, তাকে কির্তিপুর বার্ন হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ:
তীব্র বিক্ষোভ এবং সহিংসতার মুখে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারীরা তার বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়, যা পরিস্থিতির উত্তপ্ততা প্রকাশ করে।
অর্থমন্ত্রীর উপর হামলা:
রাজধানীর রাস্তায় অর্থমন্ত্রী বিষ্ণুপ্রসাদ পাওডেলকে আন্দোলনকারীরা তাড়া করে মারধর করে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ৬৫ বছর বয়সী এই মন্ত্রীকে নির্দয়ভাবে লাথি ও ঘুষি মারা হচ্ছে।
পুলিশের গুলি ও হতাহত:
সোমবার থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৯ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, এবং জলকামান ব্যবহার করেছে। কিছু প্রতিবেদনে সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং স্নাইপার ব্যবহারের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
অশান্তি ও কারফিউ:
কাঠমাণ্ডুর বানেশ্বর, সিংহদরবার, নারায়ণহিটি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। সংসদ ভবনসহ শীর্ষ নেতাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়েকজন মন্ত্রীকে সেনা হেলিকপ্টারে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।
আন্দোলনের পটভূমি:
সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধকরণ: আন্দোলনের সূত্রপাত হয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, যেখানে ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স, ইনস্টাগ্রামসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করা হয়। সরকারের দাবি, এই প্ল্যাটফর্মগুলো নেপালের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধন করেনি এবং স্থানীয় প্রতিনিধি নিয়োগের শর্ত মানেনি। এই নিষেধাজ্ঞা গত বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫) থেকে কার্যকর হয়।
দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন: প্রাথমিকভাবে সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধকরণের প্রতিবাদে শুরু হলেও, আন্দোলন দ্রুত দুর্নীতি এবং সরকারের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা, বিশেষ করে জেন জি প্রজন্ম, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে।
বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য:
কাঠমাণ্ডুর ২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ইউজান রাজভাণ্ডারি বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা থেকে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়েছে, তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। আমরা নেপালে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছি।”
২০ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ইক্ষামা তুমরোক বলেন, “আমরা সরকারের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি। আমরা পরিবর্তন দেখতে চাই।”
সরকারের অবস্থান:
নেপাল সরকার দাবি করেছে, সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ভুয়া অ্যাকাউন্ট, ঘৃণামূলক বক্তব্য, এবং সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য নেওয়া হয়েছে।
সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করে এবং এর সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে, সমালোচকরা এই নিষেধাজ্ঞাকে সেন্সরশিপ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
ডিজিটাল রাইটস নেপালের সভাপতি ভোলা নাথ ধুঙ্গানা বলেন, “হঠাৎ এ ধরনের বন্ধ সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক মনোভাব দেখায়।”
প্রভাব:
জনজীবনের উপর প্রভাব: নেপালে প্রায় ১ কোটি ৩৫ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারী এবং ৩৬ লাখ ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী রয়েছেন, যাদের অনেকে ব্যবসা ও জীবিকার জন্য এই প্ল্যাটফর্মের উপর নির্ভরশীল। নিষেধাজ্ঞার ফলে তাদের জীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা: আন্দোলনের তীব্রতা এবং সহিংসতা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং মন্ত্রীদের উপর হামলা সরকারের উপর জনগণের ক্ষোভের মাত্রা প্রকাশ করে।
পর্যবেক্ষণ:
জেন জি আন্দোলন নেপালের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গভীর ক্ষোভ এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে। সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধকরণ এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটালেও, এর মূলে রয়েছে দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদ, এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তরুণদের প্রতিবাদ। তবে, আন্দোলনের সহিংস রূপ এবং নেতৃবৃন্দের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা পরিস্থিতির জটিলতা বাড়িয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই সংকট মোকাবিলায় সংলাপ এবং সমঝোতার পথ খুঁজে বের করা জরুরি, যাতে আরও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যায়।