রিমন রহমান: পরনে জিন্সের প্যান্ট আর টি-শার্ট। গলায় গামছা। নারী হয়েও এমন বেশে রাজশাহী মহানগরীতে রিকশা চালান সুমি ক্রুস। রিকশা চালিয়েই এতদিন সুমির সংসার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু ক’দিন ধরে ভিন্ন চিত্র। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারি নির্দেশনা মতো লোকজন খুব একটা বের হচ্ছেন না। তাই গোটা শহর টো টো করে ঘুরেও যাত্রী পাচ্ছেন না সুমি। ফলে জীবন-জীবিকা নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সুমি।
গতকাল রোববার দুপুরের পর রাজশাহীতে ছিল প্রখর রোদ। গা ঝলসানো বাতাস। তার ভেতর দিয়েই রিকশা চালিয়ে আসছিলেন সুমি। নগরীর পিএন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় সুমির সঙ্গে। সুমি বললেন, রিকশা মালিককে দিতে হবে ২০০ টাকা। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে গেলেও পকেটে ঢুকেছে মাত্র ৮০ টাকা। সন্ধ্যা নাগাদ আরও ১২০ টাকা ভাড়া হওয়ার লক্ষণ নাই। গাড়ির মালিককে দিব কি আর নিজে খাব কি?
তিনি বলেন, পেটের দায়ে রোগ-ব্যাধির ভয় না করেই রিকশা নিয়ে বের হতে হয়েছে। কিন্তু রাস্তায় তো লোকজন নেই। ভাড়া হচ্ছে না। তিন দিন ধরে একই অবস্থা। এভাবে কত দিন যাবে কে জানে! আমার মতো যার কেউ নাই, তার কি হবে! কে দেখবে!’ কথাগুলো বলতেই চোখে পানি চলে আসে সুমির।
চোখের পানি মুছতে মুছতে সুমি জানালেন, অর্থ-সম্পদ কিছুই নেই। নানা কাজ করে সংসার চালিয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতায় আর ভারি কাজ করতে পারেন না। তাই রিকশার হাতল ধরেছেন। প্রায় ছয় মাস ধরেই তিনি রিকশা চালাচ্ছেন। আগে রিকশা মালিককে দিতে হতো ৩৫০ টাকা। তখন তার ৫০০-৬০০ টাকা ভাড়া হতো। রিকশা মালিককে দিয়েও তার সংসার চলে যেত। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনায় মালিক টাকার অংক কমিয়েছেন। কিন্তু এই ২০০ টাকাও উঠছে না।
সুমির গ্রামের বাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার পার্বন্নী গ্রামে। প্রায় ১৫ বছর আগে তার স্বামী মারা যান। তারপর কোলের দুই সন্তানকে নিয়ে কিছুদিন বাবার বাড়িতে থাকেন সুমি। বাবা মারা যাওয়ার পর চলে আসেন রাজশাহী। এখন নগরীর পাঁঠারমোড় এলাকায় একটি দোকানের পাশে পলিথিন দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকেন। তার বড় ছেলে বিয়ে করে শ^শুরবাড়ি থাকেন। ১৫ বছরের ছোট ছেলে থাকে এতিমখানায়। সুমির বয়স এখন প্রায় ৪৮ বছর। এই বয়সে রিকশা চালিয়ে জীবিকানির্বাহ করেন তিনি।
সুমি জানান, বড় ছেলেটা অসুস্থ। তার নিজেরই সংসার চলে না। একটা নাতি আছে। সে সুমির পলিথিনের ঘরেই আসে। কিন্তু সুমি তাকে সময় দিতে পারেন না। সুমি বলেন, পেটে ভাত দেয়ার কেউ থাকলে তো রিকশা নিয়ে বের হতাম না। এই সময় তো নাতিটাকে গোসল করিয়ে পাশে নিয়ে ঘুমাতাম।
সুমিকে রিকশা টানতে দেখে অনেকেই সাহায্য-সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। যাত্রী হয়ে আসা এক ব্যক্তি সুমিকে রিকশা কিনে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুমিকে কেউ সাহায্য করেননি। সুমি বলেন, কতো সাহায্য আসে। কিন্তু কোনো কিছুর নাগাল করতে পারিনি। শহরে কত জায়গায় চাল বিতরণ হয়। কাছে গেলে আমাকে দেয় না। বলে, তুমি এখানকার ভোটার না। তোমাকে দেয়া যাবে না। আমি বলি, আমি এতদিন ধরে আছি, আমাকে চেনেন না। আমাকে কেন দেয়া যাবে না। আমি কি এই দেশের মানুষ না? তাও লাভ হয় না। এত বড় শীত গেল, একটা কম্বল কিনতে পারিনি। কাপড় জড়িয়ে রাত কাটালাম।
অসহায় সুমি সরকারের বিধবাভাতার কার্ডও পাননি। জানালেন, নিজ এলাকা বড়াইগ্রামের জোনাইল ইউনিয়ন পরিষদে গিয়েছিলেন বিধবাভাতার কার্ড পেতে। কিন্তু কেউ তাকে পাত্তা দেননি। এখন ধরেই নিয়েছেন তার পাশে কেউ নেই। বেঁচে থাকার সংগ্রাম তাকে একাই করতে হবে, নিজের মতো করে।
সুমির বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক হামিদুল হক বলেন, এখন তো রাস্তায় মানুষ নেই। রিকশা চালালে তো ভাড়া উঠবে না। এখন তার রিকশা চালানোর দরকার নেই। তার কার্যালয়ে পাঠানো হলেই তিনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সুমির খাবারের ব্যবস্থা করে দেবেন।
Source: Sonali Sangbad
Discover more from UttorbongoProtidin.Com 24/7 Bengali and English National Newsportal from Bangladesh.
Subscribe to get the latest posts sent to your email.