রাজশাহীসহ সারা দেশের সব জায়গায় পাড়া-মহল্লায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেম ও মাদক কারবার নিয়ে তাদের বিরোধ মাঝেমধ্যেই খুনো খুনিতে রূপ নেয়। শিশু আইন অনুযায়ী, বয়সের কারণে এসব কিশোর অপরাধীদের বেশিরভাগই গ্রেপ্তারের পর শিশু আদালতে বিচার হয়। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত ও অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর অবস্থান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর অভিযান চলছে নিয়মিত।তারপরও কেন যেন কিছুতেই থামছেনা কিশোর গ্যাং কালচার।
অপরাধ বিশ্লেষক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসব কিশোরকে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে পর্যাপ্ত কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র। যাতে আইনের সঙ্গে সংঘাতে আসা শিশু-কিশোরদের অপরাধ মানসিকতা দূর করা যায়। এছাড়া কিশোর অপরাধ দমানো সম্ভব নয়।
সম্প্রতি রাজশাহীতে কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছেন তরুণীরাও। তাঁরা প্রতারণার ফাঁদ পেতে কিশোর ও তরুণদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভিডিও চিত্র ধারণ করে চাঁদাবাজি করছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ। এমন গ্যাংয়ের সদস্য ৩ কিশোরকে পুঠিয়া থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এ ছাড়া যাঁর মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করা আছে, তাঁকে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত তরুণীকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এছাড়া গেল ৩রা জুলাই রাজশাহী মহানগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে খুন হয় সানি নামের এক কিশোর। সেদিন তার জন্মদিন ছিল।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের একটি সূত্র জানায়,
ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কিছু কিশোর। তারা পাড়া মহল্লার প্রভাবশালী, মাস্তান বা বড় ভাইদের হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা একসাথে মাদক সেবন, পাড়া মহল্লায় নারীদের উত্ত্যাক্ত করা সহ ছোট ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারি ও ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে।
এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় খুন ধর্ষণের মত ঘটনাও ঘটছে। কিশোর গ্যাং এর সদস্য অপরাধ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করছে এবং পরিকল্পনা করছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার নগরীতে কিশোর অপরাধীদের ধরতে পুলিশের বিশেষ অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। ইতিমধ্যে যারা আটক হয়েছে তাদের ৩৫ ভাগই আগে লেখাপড়া করলেও এখন করে না। ৫০ ভাগ এখনো ছাত্র। এদের মধ্যে উচ্চবিত্ত আছে ১০ শতাংশ, মধ্যবিত্ত ৫০ ভাগ আর ৪০ ভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। আটককৃতদের মধ্যে ৩৫ ভাগ মাদকাসক্ত, ১০ ভাগ অনিয়মিত মাদক সেবনকারী। এরা প্রভাব বিস্তারের জন্য মারামারি, ছিনতাই, ইভটিজিং এর সাথে জড়িত।
অবশ্য রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক যোগদানের পর পরই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, ‘২০২০ সালে আমি যখন রাজশাহীতে যোগদান করি তখন এখানকার সাংবাদিক ভাইয়েরা বলেছিল, রাজশাহীতে প্রচুর পরিমাণে সাইবার ক্রাইম হয়। এরপর এক সপ্তাহের মাথায় আমি সাইবার ক্রাইম ইউনিট করি। সাইবার ইউনিট করার পর আমি দেখলাম, আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা। বিশেষ করে মেয়েরা। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাড়া-মহল্লায় আমরা দেখলাম কিশোররা ইভ টিজিংসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে। এরপরই আমরা কিশোর গ্যাংয়ের ডাটাবেজ তৈরি করলাম। তিনি আরোও বলেন, ‘কিশোররা কী করে, কোথায় যায় সবকিছুই ডাটাবেজের মধ্যে করা হলো। প্রায় ৫০০ ছেলেমেয়েকে এই ডাটাবেজের আওতায় আনা হলো। পরে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা হলো, তারা মুচলেকা দিয়ে ছেলেদের নিয়ে গেলেন। পুলিশের কাছে এখন পাড়া-মহল্লার বখাটেদের তালিকা রয়েছে। তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
তবে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক এবং রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ইউনিটের সহকারী পুলিশ কমিশনার উৎপল চৌধুরীর এই মহান উদ্যোগের কারনে কিশোর গ্যাং কালচার অনেকটাই বন্ধের পথে। নি:সন্দেহে আমরা রাজশাহীবাসী তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
এ বিষয়ে রাজশাহী সাইবার ইউনিটের সহকারী পুলিশ কমিশনার উৎপল চৌধুরী বলেন –
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশে সাইবার ইউনিট সংযোজন মাননীয় পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক স্যারের এক মহান উদ্যোগ। এটা রাজশাহী মহানগরীর জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ।
কিন্তু কথায় আছে চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। আমরা তারপরও থামাতে পারছিনা কিশোর গ্যাং কালচারকে। কারন অপরাধ বিশ্লেষকসহ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতে শুধু আইন শৃংখলা বাহিনী একাই এই কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রন করতে পারবেনা।
তবে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশসহ রাস্ট্রের স্তম্ভদের প্রতি আমার ব্যাক্তিগত অভিমত , কিশোর গ্যাংগুলো রাষ্ট্রের কাঠামোগত সন্ত্রাসের প্রতিবিম্ব। ‘গ্যাং-কালচার’ ভয়ের শাসনেরই প্রতিধ্বনি। তারা হয়ে ওঠে বড় মাফিয়াদের অনুকৃতি বা মিনিয়েচার। দমন ও সংশোধনের কাজ জারি থাকুক। কিন্তু এই গভীর সামাজিক ও প্রজন্মগত ব্যাধির নিরাময় পুলিশি পন্থায় হওয়ার নয়। পুলিশের কাজ লক্ষণ নিয়ে। সমস্যার উৎস নির্মূল সমাজ-রাষ্ট্র, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক-রাজনৈতিক নেতাদের কাজ। কিশোর গ্যাংয়ের বিগ ব্রাদারদের ক্ষমতার পাইপলাইন কাটা পড়লেই গ্যাংবাজির প্রতাপ তলানিতে নেমে আসবে।
অবশ্য সমাধানের একটা রাস্তা আছে বৈকি। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহর শিল্প শ্রমিকের শহর। ১৯ শতকের মাঝামাঝি এই ম্যানচেস্টার শহরে তরুণ গ্যাংগুলোর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মহামারি দেখা যায়। কিন্তু ১৮৯০ সালের দিকে শহরটির কিছু দূরদর্শী মানুষ ও রাজনীতিবীদ একটা পরামর্শ করলেন। তাঁরা শহরজুড়ে শ্রমিক যুবকদের জন্য স্পোর্টিং ক্লাব তৈরি করে বস্তিবাসী যুবকদের খেলা ও বিনোদনের সুযোগ করে দিলেন। তরুণ বয়সের গরম রক্ত সুস্থ খাতে বয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে মাস্তানি ছেড়ে দিল সবাই। মাস্তানির উন্মাদনার জায়গা নিল ফুটবল ‘উন্মাদনা’। সে সময়ই ওই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাব। বাকিটা ইতিহাস আপনারা জানেন। আজ বিশ্ববাসী ম্যানচেস্টার শহরকে খেলাধূলার শহর হিসেবেই চেনেন।
পরিশেষে বলতে চাই, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রন করা যাবেনা আর এজন্যই আমাদের সকলকেই সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা থেকেই এর দ্বায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে। গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে আমাদেরকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে শক্ত অবস্থান থেকে তবেই আগামী প্রজন্ম তথা আগামীর ভবিষ্যত রক্ষা করা সম্ভব হবে ।
প্রধান সম্পাদক : উত্তরবঙ্গ প্রতিদিন
সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার – দৈনিক মাতৃভূমির খবর
সভাপতি: রাজশাহী মডেল প্রেসক্লাব,রাজশাহী
shortlink : https:\/\/preview-xupnewsc.uttorbongoprotidin.com//preview-xupnewsc.uttorbongoprotidin.com//wp.me/pbH2Ba-oUR
Discover more from UttorbongoProtidin.Com 24/7 Bengali and English National Newsportal from Bangladesh.
Subscribe to get the latest posts sent to your email.