অথই সাগরে মরে যেতে পারতাম

Rajshahi_Pet_Care
উত্তরবঙ্গ প্রতিদিনের সংবাদটি শেয়ার করুন

নিজস্ব প্রতিনিধি,উত্তরবঙ্গ প্রতিদিন::ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে লিবিয়ার মাটিতে পা রেখেছিলাম ছয় মাস আগে। আজ সবকিছু হারিয়ে ফিরে এসেছি শূন্য হাতে। স্বপ্ন দেখার মনটাও মরে গেছে। তারপরও মৃত্যুকূপ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছি, এটাই অনেক।

বাংলাদেশ থেকে ভারত, দুবাই, তিউনিসিয়া হয়ে লিবিয়া। পথে পথে বুঝেছি, আমি এক অচেনা-অজানা জগতে এসেছি। সর্বশেষ উড়োজাহাজে লিবিয়ায় নামার পরই দালালের মাফিয়া বাহিনী আমাকে ধরে নিয়ে যায়। আটকে রাখে একটি ঘরে। চুক্তির ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা তাদের বাংলাদেশি এজেন্টকে দেওয়ার পর তারা ছেড়ে দেয়।

অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কের জীবন

লিবিয়ায় অনিশ্চিত জীবনের শুরু হলো। আমাদের মাদারীপুরের ভাই ও বন্ধুদের খোঁজ করি, যাঁদের আশ্বাসেই আমি পা বাড়িয়েছিলাম। তাঁরাই আমাকে একসময় একটা কাজ জোগাড় করে দেন। এক মাসের মতো কাজ করি। কিন্তু কাজটা ভালো ছিল না। সেখানে আমাদের মাদারীপুরের একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনিই আমাকে ইতালি যাওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘এখানে যারা নতুন আসে, তারা মাফিয়াদের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। তাই বিক্রি হওয়ার চেয়ে একটু কষ্ট হলেও ইতালি যাওয়া ভালো।’

ইতালি যাওয়ার জন্য সাগর পাড়ি দিতে হয় নৌকায়, তবে জাহাজে যাওয়ারও সুযোগ আছে। আমি যদি এখন গেমে (অবৈধ যাত্রা) উঠি, তবে জাহাজে যাওয়া যাবে বলে একটি জাহাজের ছবিও দেখান লোকটা। আরও বলেন, ‘নয়তো মাফিয়াদের হাতে পড়লে মারও খাবে, এমনকি জীবনও চলে যেতে পারে। তাই সময় থাকতে চলো।’

প্রথমে রাজি হইনি। পরে ভাবলাম, একই জেলার লোক, ভরসাও দিচ্ছেন, খারাপ কী। প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। তখন তিনি শর্ত দিয়ে বসেন। শর্তটা হলো, তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। চুক্তির টাকা যাত্রার আগেই দিতে হবে। অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, মাফিয়াদের হাতে মরার চেয়ে ইতালি যাওয়ার সুযোগটা নিই। যদি যেতে পারি, তাহলে তো ভাগ্যের চাকা খুলে গেল। বিষয়টা বাড়িতে জানাই। বাড়ি থেকে আবার ধারদেনা করে আড়াই লাখ টাকা পাঠায়। সেই টাকা তুলে দিই ওই লোকের হাতে।

টাকা পেয়েই আমাকে শহরের একটি নির্জন এলাকায় নিয়ে যান ওই লোক। সেখানে একটি ভবনে আমাকে তোলেন। গিয়ে দেখি, আমার মতো আরও অনেক মানুষ এখানে আটকা। এটাকে গেমঘর (অবৈধ পথে যাত্রার আগে যেখানে রাখা হয়) বলে। ঘরে কোনো আলো-বাতাস নেই। অপেক্ষমাণ সবাইকে দেখলাম হাহাকার করছেন। কেউ একটু শব্দ করলেই তাঁর ওপর নেমে আসছে অত্যাচার। তখন আমিও তাঁদেরই একজন।

প্রায় চার মাস সেই ঘরে আটক ছিলাম। এক বেলাও ঠিকমতো খাবার পাইনি। চারটা মাস এক দিনও পেট ভরে খাইনি। একটু পানি বেশি খরচ করলে কোনো কোনো দিন খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিত। সেখানে সব ধরনের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। নীরবে কেঁদেছি, আর আল্লাহর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছি।

ভয়ংকর যাত্রার শুরু

যাঁর হাত ধরে এই অনিশ্চিত পথে পা বাড়ালাম, সেই রাসেল একদিন এলেন। বললেন, ২২ রমজান যাত্রার তারিখ। যাত্রার দিন আমাদের প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ হাঁটিয়ে সাগরপাড়ে নেওয়া হলো। সেখানে গিয়েই তো অবাক হয়ে গেলাম। দেখি জাহাজ নয়, অপেক্ষা করছে স্পিডবোট। দুটি বড়সড় স্পিডবোটে আমাদের ৭৫ জনকে জোর করে তোলা হয়। কেউ কেউ উঠতে চাইলেন না। তাঁদের ওপর নেমে এল নির্মম নির্যাতন, গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি। বাধ্য হয়ে সবাই উঠে পড়ি। সেদিন সারা রাত সাগরে স্পিডবোট চলে। পরদিন ভোরবেলা লিবিয়া সীমান্তের কাছে এলে একটা বোটে সবাইকে উঠতে বলা হলো। অন্য বোটটিতে শুধুই দালাল রাসেল আর তিন সহযোগী। দালালেরা আমাদের বোটের মিসরীয় চালককে একটি ম্যাপ দিয়ে ইতালি যেতে বলেন। তাঁরা লিবিয়ায় ফিরে যান।

খাবার ছাড়া নৌকায়

এক নৌকায় ৭৫ জন আমরা। কারও সঙ্গেই নেই কোনো খাবার। পরদিন বিকেলবেলা ঝড় শুরু হলো। সাগরে তখন বিশাল বিশাল ঢেউ। নৌকার সবাই চিৎকার শুরু করেছেন। কারণ নৌকাটি সাগরে একবার উল্টে গেলে সবাই মারা যাবে।

সৃষ্টিকর্তার রহমতে আমরা সাগরে ওঠা ঝড় কোনোভাবে কাটিয়ে উঠি। সাগরে তিন দিন সবাই না খাওয়া। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে ঢলে পড়েছেন। কারও শরীরে শক্তি নেই। সবাই যেন ক্রমশ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। সাগরে তৃতীয় দিন কাটানোর পর একটি আলো দেখতে পাই। পরে নৌকা নিয়ে আমরা ওখানে গেলে দেখি তিউনিসিয়ার একটি তেলবাহী বড় জাহাজ। আমরা ওই জাহাজে উঠতে চাইলে তারা আমাদের প্রথমে ওঠায়নি। তখন আমাদের নৌকায় জ্বালানি শেষ, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ওই জাহাজের কাছে জ্বালানি তেল চাইলে তারাও তেল দেয়নি।

ওই জাহাজের পাশেই আমরা একদিন ভাসতে থাকি। বুঝতে পারি, আমরা দুর্ঘটনার শিকার হলে তখন ওই জাহাজের নাবিকেরা আমাদের উদ্ধার করবে। পরে আমরা কয়েকজন তেলের ড্রাম সাগরে ভাসিয়ে লাফিয়ে পড়ি। আর ওই জাহাজের কাছে সাঁতরে যাই। জাহাজের নাবিকেরা আমাদের অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে আমাদের উদ্ধার করেন। এরপর জাহাজে কেটে যায় ১৯ দিন। জাহাজের লোকজন আমাদের কমবেশি খেতে দিতেন।

ওই জাহাজটি তিউনিসিয়ার বন্দর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ভাসমান রাখে। পরে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস ও আইওএমের (আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থা) লোকজন এলে ওরা আমাদের দেশে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করে। আমরা প্রথমে দেশে ফিরে যেতে চাইনি, বলেছি, এখানেই আমাদের কাজের ব্যবস্থা করে দাও। কিন্তু তারা দেশে ফিরে যেতে বলে আমাদের সঙ্গে চুক্তি সই করে। পরে তারাই ২৫ দিনের মাথায় আমাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়।

অনুলিখিত


উত্তরবঙ্গ প্রতিদিনের সংবাদটি শেয়ার করুন

Discover more from UttorbongoProtidin.Com 24/7 Bengali and English National Newsportal from Bangladesh.

Subscribe to get the latest posts sent to your email.