ইমরান আহম্মেদ :: ছোট বেলার কথা। বিটিভিতে প্রতি শুক্রবার বেলা তিনটায় একটা করে বাংলা সিনেমা দেখাত। আমরা যারা ছেলে-পুলে কিংবা আশপাশের বাড়ির মামী, খালারা দল বেধে টিভি দেখতে যেতাম। যতগুলো বাংলা ছবি সেই ছোট বয়সে দেখেছি, তার কোনটিতে পুলিশ চরিত্রগুলো ছিল হয় ‘ঘুষখোর’ না হয় ‘বড় লোকের চামচা’। কোনোটাতে ‘চরিত্রহীন’ আবার কোনটাতে ‘বদমেজাজী’। কোনটাতে ‘কর্কশ’ আবার কোনটাতে ‘গুণ্ডাদের দোসর’। আবার কোনটাতে ‘জোকার’ কিংবা কোনটাতে ‘বেয়াক্কেল’ স্বভাবের। ছবির শেষে যখন নায়ক পুলিশকে মারত, আমাদের খুশি দেখে কে! ছোট বয়সে ছবি দেখে দেখে পুলিশ সম্পর্কে অবচেতনভাবেই আমার মনে তীব্র একটি পুলিশ বিদ্বেষী মনোভাব জন্ম নেয়।
সিনেমাতে যেমন দেখি, পুলিশ কি আসলেই তেমন—সেই ছোট থেকে চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো দিনই বিবেচনা করিনি। প্রত্যন্ত গ্রামে বাড়ি হওয়ায় খুব সহসা আমরা পুলিশের দেখা পেতাম না। মাঝে মধ্যে গ্রামের বাজারে কোনো কারণে পুলিশ এলে সেটি মায়েদের জন্য খুব কাজে দিত। ছোট শিশুরা ভাত না খেলে কিংবা না ঘুমালে তখন তাদের ভয় দেখানো হতো—‘বাজারে পুলিশ আসছে, না খেলে/না ঘুমালে ধরে নিয়ে যাবে।’ সেই বাল্যকাল থেকেই, পুলিশ মানে সাক্ষাৎ আতঙ্ক। এর কয়েক বছর পরের ঘটনা। একটা সিনেমায় দেখলাম, ছবির নায়ক পুলিশ। আমার বিরক্তি দেখে কে? এতকিছু থাকতে নায়ককে পুলিশ হতে হবে কেন? নায়ক পুলিশ এটা কোনোভাবেই আমি মানতে পারিনি।
কিছু সিনেমা বাদে আমাদের দেশের সিনেমাগুলোতে এভাবেই পুলিশকে উপস্থাপন করা হয়েছে। বছরের পর বছর। মাসের পরে মাস। যা এখনো চলছে। এসব সিনেমায় পুলিশকে ‘ভিলেন’ হিসেবে উপস্থাপন করায় সাধারণ মানুষ অবচেতনভাবেই পুলিশকে ‘ভিলেন’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এখন পুলিশকে সেই ধারণার ব্যতিক্রম করতে দেখলে অনেকেই তা সহসা মেনে নিতে পারেন না। বিশেষ করে তারা তো পারেন-ই না, যারা আমার মতো ধারণা পেয়ে বেড়ে উঠেছেন।
তবে এটাও ঠিক, সিনেমায় যা দেখানো হয়েছে তা সব সময় মিথ্যা না। এর জন্য পুলিশেরও কিছুটা দায় তো ছিলই। তা না হলে বছরের পর বছর এমনভাবে উপস্থাপিত হলো, তেমন প্রতিবাদ তো করল না পুলিশ। সত্যি কথা বলতে কি, এমন নেতিবাচক উপস্থাপনের পেছনে রয়েছে বেশ কিছু ইতিহাস। আদতে ব্রিটিশদের হাত ধরেই এই উপমহাদেশে পুলিশের জন্ম। যেহেতু ব্রিটিশেরা ভিনদেশি, এদেশে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তাদের একটা ‘লাঠিয়াল’ বাহিনীর দরকার ছিল। কাগজে কলমে যা লেখা থাকুক না কেন, কার্যত এ উপমহাদেশে ওই উদ্দেশ্যেই পুলিশ বাহিনী তৈরি করে তারা। এখন একটি সংস্থাকে জনবিরোধী একটি শাসক গোষ্ঠীর ‘জনবিরোধী’ উদ্দেশ্য হাসিল করতে ব্যবহার করা হয়, তখন ওই সংস্থার প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণা হতে বাধ্য। পুলিশের ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। তাই ব্রিটিশদের সঙ্গে ৮৬ বছরে পুলিশ ছিল কেবল তাদেরই সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান।
ব্রিটিশেরা গেল। এল পাকিস্তান। পাকিস্তান ভূখণ্ডে জিন্নাহর অবদানে ভিন্ন মোড়কে কার্যত ব্রিটিশ শাসনই অব্যাহত ছিল। ব্রিটিশদের মতো পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পুলিশকে তাদের নিজেদের প্রয়োজনে ‘লাঠিয়াল’ হিসেবেই চাইল। পাকিস্তান আমলে শোষণ নির্যাতন তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল, তাই সেই কাজটি করাতে পুলিশের মধ্যে বেশি করে ‘ইন্ট্রুডার’ আনা হলো। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন বলুন, ১৯৬২ এর শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আন্দোলন বলুন। ১৯৬৬ এর ছয় দফা কিংবা ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান। সব কিছুতেই এদেশের মানুষ পুলিশকে কেবল তাদের উল্টো পাশে লাঠি-বন্দুক নিয়ে দাঁড়াতে দেখেছে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের এসব আন্দোলনে পুলিশ যেভাবে আন্দোলনকারীদের গোপনে সহযোগিতা করেছে, তার বড় একটা অংশ কোনোদিনই প্রকাশ হয়নি। আর করাও যায়নি।
তৎকালীন পুলিশের সদস্যরা গোপনে স্বাধীনতাকামীদের সহযোগিতা করে যাচ্ছিল, সেটা কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। তাইতো মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই ছক কষে পুলিশকে অস্ত্র শূন্য করার প্রয়াস চালানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাক হানাদার বাহিনীর প্রথম আক্রমণের শিকার হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনস। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের বুলেট ছোড়ে পুলিশ। প্রতিরোধ গড়ে পুলিশ। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য প্রথম আত্মদানকারীও পুলিশ। কিন্তু অবাক বিষয়, এই তথ্য এখনো অনেকের অজানা। এমনকি কয়েক বছর আগে আমি নিজেও জানতাম না
শুধুই কি তাই। মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান কয়েক বছর আগেও কজন জানত? ঠিক কতজন পুলিশ সদস্য দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা এখনো পুরোপুরি হিসাব করা যায়নি। এখন পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের হিসাবে সাড়ে সাত শ এর বেশি আত্মদানকারী পুলিশ সদস্যের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। কিন্তু তাদের কজনের নাম এদেশের মানুষ জানে? পুলিশের অবদান কেন প্রচার পেল না, সেটি কেউ খুঁজে দেখেছেন। এর দায়ভার কি শুধুই পুলিশের? হয়তো বলবেন, পুলিশ কেন করেনি। সেই উত্তরের আগে খুঁজতে হবে পুলিশকে প্রচারের সুযোগটা দেওয়া হয়েছিল কিনা? যারা ইতিহাস সংকলন করেছেন, লিপিবদ্ধ করেছেন, তাদের কি কোনো দায় নেই?
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নানা রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে। জাতির পিতা প্রথম পুলিশ সপ্তাহে বলেছিলেন, স্বাধীন দেশের পুলিশ হতে। জনমানুষের পুলিশ হতে। সে পথে ধরেই এগুচ্ছিল বাংলাদেশ পুলিশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতির পিতা নিহত হওয়ার পর পুলিশে আবারো পাকিস্তান ‘সিনড্রোম’ ফিরিয়ে আনা হয়। পুলিশকে যতটা না সাধারণ মানুষের কল্যাণে পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল, বরং তার উল্টোটা করা হয়। গণতন্ত্র ফেরাতে দীর্ঘ সময় ধরে চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন। আবারও পুলিশের অবস্থান আন্দোলনকারীদের উল্টো দিকে। লাঠি-বন্ধুক হাতে। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের সরকারবিরোধী আন্দোলনে সরকারের পক্ষে মাঠে কাজ করতে হয়েছে পুলিশকে। কারণ আইনটাই এমন। সরকারের কথা শুনতে পুলিশ বাধ্য। সেটা যে সরকারই হোন না কেন। ইউনিফর্মের কারণে পুলিশই দৃশ্যমান।
বেতের বাড়িও দেয় পুলিশ। সরকারের হুকুমে গুলিও চালায়। তাই যত রাগ, যত ক্ষোভ সবই পুলিশের উপর। কেউ খুঁজেও দেখেনি এসব কি পুলিশ স্বেচ্ছায় করেছে নাকি করানো হয়েছে। অনেকটা বিবেচনাহীনভাবেই সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশ হয়ে যায় ‘ভিলেন’।
এসব কারণেই এর প্রভাব পড়ে সিনেমায়। মানুষ যেহেতু পুলিশকে ‘ভিলেন’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত, তাই কাহিনীকার কিংবা চলচ্চিত্র নির্মাতারা পাল্টানোর ঝুঁকি নিতে গেলেন না। তারা পুলিশকে ‘ভিলেনের’ আসনে রাখতেই বেশি লাভ দেখলেন। আর তাতে দর্শকদেরও সায় মিলল বেশ। কিন্তু এসবের ফলে বড় ক্ষতিটা হলো পুলিশেরই। যতই ভালো কাজ করুক না কেন, বর্তমানে বিদ্যমান অন্তত দুটি জেনারেশনের মধ্যে পুলিশের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা অস্থিমজ্জায় গ্রথিত হয়ে আছে। তারা পুলিশের হাতে ভিকটিম হোক বা না হোক, ধারণাটা হলো ‘অলওয়েজ নেগেটিভ’। জনমানুষের এমন ধারণাই এখন পুলিশকে ভালো কাজে উৎসাহিত করার পথে অন্যতম প্রধান বাধা। যখন হাজারটা ভালো কাজ করেও সেটির প্রকাশ পায় না কিন্তু সামান্য বিচ্যুতি প্রকাশ পায় ঘটা করে, তখন হতাশা আসবেই। আর সেটাই হচ্ছে বারংবার।
পুলিশকে যেহেতু মানুষের মনে ‘ভিলেন’ বানাতে বড় অবদান ছিল চলচ্চিত্রের, তাই পুলিশকে ‘নায়কের’ আসনে বসাতেও চলচ্চিত্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ মানুষের সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র বা বিনোদন মাধ্যমের প্রভাব ব্যাপক। মানব মনে এটির প্রভাবে থেকেও বহুদিন।
মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে কোনো না কোনোভাবে পুলিশ জড়িত। পুলিশ খারাপ হলে যেমন ভুক্তভোগী হবে নাগরিকগণ, তেমনি পুলিশ ভালো হলে সুবিধাভোগীও হবে সম্মানিত নাগরিকগণই। পুলিশকে ‘নায়ক’ জায়গায় তুলে দিলে যেমন ‘নায়কোচিত’ ব্যবহার পাওয়া যাবে, তেমনি ‘ভিলেনের’ আসন দিলে উল্টোটা পাব। সুতরাং দেশ, মাটি আর মানুষের কল্যাণে নায়ক বানানোই মঙ্গলজনক।
‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার’-এই স্লোগানে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। সেবাদান প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং মানুষের দোরগোড়ায় পুলিশি সেবা পৌঁছে দিতে নেওয়া হচ্ছে নানান উদ্যোগ। এসবের হাত ধরেই গড়ে উঠবে ইতিবাচক ভাবমূর্তি। কিন্তু এ পরিবর্তনকালীন সময়ে পুলিশকে সহযোগিতার জন্য সম্মানিত নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। গুজব কিংবা কেবলমাত্র ধারণার বশে নেতিবাচক মনোভাব পুষে রাখলে হবে না। পুলিশ ভুল করলে ধরিয়ে দিন যৌক্তিক ও গঠনমূলক সমালোচনা করুন। কিন্তু অবচেতন মনে পুষে রাখা নেতিবাচক ধারণার বশীভূত হয়ে পুলিশকে ভালো কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করবেন না। প্লিজ।
মো. ইমরান আহম্মেদ: সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস)।
বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা
Discover more from UttorbongoProtidin.Com 24/7 Bengali and English National Newsportal from Bangladesh.
Subscribe to get the latest posts sent to your email.