গঙ্গা রামলালকে সামনে পেলেই জিজ্ঞেস করতো বোম্বে নগরী কেমন, সে সিনেমা দেখে কিনা ইত্যাদি। রামলাল বোম্বে নগরী সম্পর্কে তাকে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করতো। অচিরেই গঙ্গা রামলালকে জানালো, বোম্বে নগরী দেখার খুব শখ তার। সে নায়িকা হতে চায়। ধীরে ধীরে গঙ্গা রামলালের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়লো। তাদের ঘনিষ্ঠতা ভালোবাসায় রুপ নিলো। বাড়ির বাইরে তারা দুজন একান্তে দেখা করতো। রামলাল বললো, গঙ্গাকে কে সে মুম্বাই নিয়ে যাবে। কারণ, সিনেমায় কাজ করে এমন কিছু লোকের সাথে তার পরিচয় আছে, যারা গঙ্গাকে নায়িকা বানাতে সাহায্য করবে।একে তো রামলালের সাথে তার গভীর প্রেমের সম্পর্ক, অন্যদিকে সিনেমার নায়িকা তাকে হতেই হবে- এই দুই ইচ্ছাকে মাথায় নিয়ে গঙ্গা মুম্বাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলো।
গঙ্গা জানতো, রামলালের সাথে বিয়ে কিংবা ফিল্মের নায়িকা হওয়া- কোনোটাই তার রক্ষণশীল পরিবার মেনে নেবে না। তাই তারা মুম্বাই পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তুু রামলাল গঙ্গাকে এবার বিক্রি করে দিল পতিতালয়ে। গঙ্গা পাগল প্রায় অবস্থায় পতিতালয় থেকে কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। অবশেষে নিয়তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে বাধ্য হলো সে।
যেহেতু এক লম্পটের হাতে পড়ে তার জীবন শেষ হয়ে গেছে, এখন আর কেঁদে কেটে কী লাভ হবে। আর আসলেই তো তার পরিবারের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না সে। এক সপ্তাহ পর শীলা মাসীর কাছে গঙ্গা আত্মসমর্পণ করলো। শীলা মাসীর কাছে তার নাম পরিবর্তন করে বললো গাঙ্গু। নিজের এলাকা কাতিয়াবাদী যোগ করে এই গাঙ্গুই হয়ে উঠল কামাথিপুরার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী গাঙ্গুবাঈ কাতিয়াবাদী।
এবার গাঙ্গুবাঈ যখন ঘরছাড়া মেয়েদের নিরাপদ আশ্রয় স্থল হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। যেহেতু গাঙ্গুবাঈ ছিলো তুলনামূলকভাবে একটু শিক্ষিত ও অভিজাত পরিবারের সন্তান, অচিরেই কামাথিপুরার অন্য মেয়েরা তাকে সমীহ করতে লাগলো। পতিতালয়ের বাসিন্দাদের মধ্যে নেতা নির্বাচনের জন্য নির্বাচন হতো, যাকে বলা হতো ঘরওয়ালী নির্বাচন। বিপুল সমর্থন নিয়ে গাঙ্গুবাঈ ঘরওয়ালী নির্বাচনে জিতে কামাথিপুরার সর্দারনী বনে গেলো খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। স্বয়ং শীলা মাসী গাঙ্গুবাঈকে ভয় পেতে লাগলো।
এপরপরই মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের পাঠান মাফিয়াদের সর্দার করিম লালাকে রাখি পড়িয়ে ভাই বানিয়ে গাঙ্গুবাঈ নির্বিঘ্নে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করলো কামাথিপুরায়। গাড়ি, বাড়িরও মালিক হয়ে গেলো সে। কিন্তুু এতসবের ভিড়েও গাঙ্গুবাঈয়ের সেই কিশোরী মনটার পরিবর্তন হয়নি। যখনই কোনো নতুন মেয়ে কামাথিপুরায় আসতো, গাঙ্গুবাঈ কখনো তাকে জোর করতেন না। এমনও হয়েছে, কোনো মেয়ে এখানে থাকতে রাজি না হলে গাঙ্গুবাঈ নিজ খরচে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন।
গাঙ্গুবাঈ দি প্রেসিডেন্ট অব কামাথিপুরা!
ষাট ও সত্তর দশক জুড়ে গাঙ্গুবাঈয়ের এই নেতৃত্বে নিরাপদ থেকেছে কামাথিপুরার বাসিন্দারা। গাঙ্গুবাঈ প্রকাশ্যে সমর্থন করতেন পতিতালয়ের প্রয়োজনীয়তাকে। তিনিই কামাথিপুরার বাসিন্দাদের নাগরিক অধিকার আদায়ে আন্দোলন করতেন। একবার মুম্বাই নগরীর বিখ্যাত আজাদ ময়দানে হাজার হাজার দেহকর্মীদের সম্মেলনে তাকে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখার অনুরোধ করা হয়। গাঙ্গুবাঈয়ের অগ্নিঝরা বক্তব্য পুরো ভারত জুড়েই আলোড়ন তুলেছিলো। তাকে পরিচয় দেওয়া হয়েছিলো এই বলে যে, এখন বক্তব্য দেবেন ‘প্রেসিডেন্ট অব কামাথিপুরা’! মাইক হাতে নিয়ে গাঙ্গুবাঈ বলতে লাগলেন,
“ভারতের অনেক শহরের তুলনায় মুম্বাই অনেক নিরাপদ। মহিলাদের যৌন হয়রানির ঘটনা এখানে ঘটে না বললেই চলে। এই কৃতিত্বের পুরো দায়ভার সিটি করপোরেশনের নয়, কামাথিপুরার যৌনপল্লীরও এতে অবদান আছে। দেশের জওয়ান সৈনিকরা যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করে আমাদের শান্তির জন্য, ঠিক তেমনি আমরা পতিতালয়ের বাসিন্দারা নিজের সাথে প্রতি মুহুর্তে লড়াই করে চলেছি। কেন সৈনিকেরা পুরস্কৃত হবে, আর পতিতাদের কপালে জুটবে লাঞ্চনা আর অপমান? উত্তর দিন! আমি জানি কারো কাছে এর উত্তর নেই।
হায়দারাবাদের মতো প্রাচীনপন্থী নগরে যদি পতিতালয়কে আদর করে ডাকা হয় ‘মেহবুব কি মেহেন্দি’, তাহলে মুম্বাইতে কেন পতিতাদের কপালে জুটবে ঝাঁটার বাড়ি? মনে রাখবেন, আমরা সবাই বাড়িতে টয়লেট রাখি এজন্য যে, বাড়িটার সর্বত্র যাতে দুর্গন্ধ না ছড়ায়। ঠিক তেমনি প্রত্যেক শহরে পতিতালয় দরকার আছে, যাতে করে শহরের পরিবেশ যত্রতত্র নোংরা না হয়।” পরেরদিন পুরো ভারতের বহু পত্রিকার হেডলাইনে গাঙ্গুবাঈয়ের ভাষণ প্রকাশিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সাথে বৈঠক গাঙ্গুবাঈয়ের
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সাথে গাঙ্গুবাঈয়ের সাক্ষাত ছিলো অত্যন্ত চমকপ্রদ ঘটনা। কামাথিপুরা সংলগ্ন একটি বালিকা বিদ্যালয় ছিলো। ষাটের দশকে বালিকা বিদ্যালয়ের অভিভাবকবৃন্দ এই পতিতালয় উচ্ছেদের জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন।
গাঙ্গুবাঈয়ের নেতৃত্বে কামাথিপুরার বাসিন্দারা রাস্তায় নামে তাদের জীবিকা টিকিয়ে রাখার জন্য। তাদের যুক্তি ছিলো, কামাথিপুরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পরে বিদ্যালয় হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতারা তখন কেন এখানে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন? এখন কিছুতেই পতিতালয় উচ্ছেদ করা যাবে না। দরকার হলে বিদ্যালয় উচ্ছেদ হবে।
এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে নেহেরুর সাথে সাক্ষাতের আবেদন করে তাদের দাবি দাওয়া পেশ করতে উদ্যত হন গাঙ্গুবাঈ। নিজের ব্ল্যাক বেন্টলি গাড়িতে করে নেহেরুর মুখোমুখি হন তিনি নয়াদিল্লীতে। গাঙ্গুবাঈয়ের বাচনভঙ্গি দেখে মুগ্ধ নেহেরু তাকে বললেন, “কেন তুমি এই নোংরা কাজের সাথে জড়িয়ে আছ? তুমি কি এসব থেকে বেরিয়ে এসে একটা ভালো কিছু করতে পারো না?”
গাঙ্গুবাঈ উত্তর দিলেন, - “আমি এ কাজ ছাড়তে রাজি আছি যদি আপনি আমাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেন। এর চেয়ে ভালো নিশ্চয়ই আর কিছু হতে পারে না?”
ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে নেহেরু তাকে বললেন, “তোমার সাহস তো কম না? আমার সামনে এসব কথা বলো?”
বিনীত গাঙ্গুবাঈ উত্তর দিলেন, “রাগ করবেন না প্রধানমন্ত্রীজী, আমি শুধু আপনার প্রতিক্রিয়াটা দেখতে চেয়েছিলাম। এখন বুঝলেন তো, উপদেশ দেওয়া কতো সহজ, আর উপদেশ বাস্তবায়ন করা কত কঠিন!”
মিটিং সফল হলো। পতিতালয় উচ্ছেদ হলো না। স্কুল অন্যত্র সরে গেলো।
আজ কামাথিপুরার সেই জৌলুশ নেই। নেই কুখ্যাত মাফিয়াদের আনাগোনা। তাই বলে কি দেহব্যবসা থেমে গেছে মুম্বাইয়ে? কখনোই না। কলকাতার মিডিয়ার ভাষায়, বদ্ধ পতিতালয় পরিবর্তিত হয়ে গেছে মধুচক্র, এসকর্ট সার্ভিস, রুম ডেলিভারি ইত্যাদি বাহারি নামে।
কিন্তু আজ আর নেই গাঙ্গুবাঈ কাতিয়াবাদী। সত্তর দশকের শেষে তিনি মারা যান। তবে কামাথিপুরার যে মুষ্টিমেয় কিছু বাসিন্দা আছে, তাদের ঘরে ঘরে আছে গাঙ্গুবাইয়ের প্রতিকৃতি। তিনশো বছর যাবত কত মেয়ের চোখের জলে ভিজলো কামাথিপুরার অলিগলি, কে তার খবর রাখে? কিন্তুু গাঙ্গুবাঈ অম্লান রয়ে গেল সবার মাঝে।
আর সেই ধারাবাহিকতায় বলিউডে নির্মিত হলো সঞ্জয়লীলা বানশালী পরিচালিত ও আলিয়া ভাট অভিনীত সিনেমা গাঙ্গুবাঈ।
[embed]https:\/\/preview-xupnewsc.uttorbongoprotidin.com//preview-xupnewsc.uttorbongoprotidin.com//youtu.be/N1ZwRv3vJJY[/embed]
প্রকাশক:ফাহমিদা খান, প্রধান সম্পাদক:এম.এ.হাবিব জুয়েল,বার্তা সম্পাদক : রমজান আলী কর্তৃক উত্তরা ক্লিনিক মোড়,উপশহর,বোয়ালিয়া,রাজশাহী-৬২০৩,বাংলাদেশ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত।বার্তা কক্ষ ০১৭১৫৩০০২৬৫ । ইমেইল: uttorbongoprotidin@gmail.com