তবে একথা অনস্বীকার্য যে ডয়েচে ভেলের বিশিষ্ট সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিন বলেছেন - ‘আমরা সাংবাদিক, সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আমরা সবাইকে প্রশ্ন করার ক্ষমতা রাখি’
আর বলাবাহুল্য যে, এই অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ৩০টি আইনের মধ্যে দিয়ে। আর প্রশ্ন থাকতে পারে আমাদের দেশের সংবিধান কি সেই অনুমতি আমাদের দেয়?
তবে গর্বের সাথে আমরা বলতে পারি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল এক্ট ’ পাশের মধ্যে দিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার অধিকার সুনিশ্চিত করেছেন। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র ১০ মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ সংবিধানে ৩৯ অনুচ্ছেদে অর্থাৎ ARTICLE 39 সংযুক্ত করে বিল উত্থাপিত করলে তা সর্ব সম্মতিক্রমে পাশ করা হয়। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে - বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হল।
কিন্তু এই মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলের জন্যে প্রযোজ্য হলেও সরকারী ক্ষেত্রে আছে প্রতিবন্ধকতা। গেল ১৫ বছরে ধরে দেশে বিভিন্ন ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক কিংবা গ্রেপ্তারের পর নারী-পুরুষদের প্রায়ই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করার ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক হলেও এখন তার আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতাই বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। যাকে শাব্দিক অর্থে বলা হয়ে থাকে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’।
যেখানে জব্দ করা জিনিসপত্র সাজিয়ে এমনভাবে তাদের উপস্থাপন করা হচ্ছে ও বর্ণনা তুলে ধরা হচ্ছে, তাতে বিচারের আগেই জনমনে দোষী চিহ্নিত হচ্ছেন তারা। প্রদর্শিত ব্যক্তির বক্তব্য দেয়ার সুযোগও হচ্ছে না। অনেকের ক্ষেত্রে নানা রকম আপত্তিকর বিশেষণও ব্যবহার হয়। নাগরিক সমাজের অনেকেই তো প্রশ্নই ছুঁড়ে দিয়েছেন - আদালত কর্তৃক উক্ত ব্যাক্তি যদি নির্দোষ প্রমানিত হয় তবে তখন কি হবে ? এক্ষেত্রে ঐ ব্যাক্তির মানহানির দ্বায়ভার কে নেবে?
মিডিয়া ট্রায়াল কর্মকাণ্ড বন্ধে ২০১২ সালে নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছিল বাংলাদেশ হাইকোর্ট। তবে এখন পর্যন্ত হাইকোর্টের এই নির্দেশ কাউকে পালন করতে দেখা যায়নি।
এভাবে প্রায় প্রতিদিনই বাহবা কুড়ানোর প্রতিযোগিতায় কিংবা এই প্রক্রিয়ায় অপরাধ কমিয়ে আনার ভ্রান্ত ধারণায় আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে হাজারো গ্রেফতারকৃত ব্যাক্তিকে সামাজিক সাজার সম্মুখীন করছে পুলিশ। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করেই মিডিয়া ট্রায়ালের ঘটনা তো ঘটছেই। তাহলে প্রশ্ন জাগে, মিডিয়ার দরকার কি?
এদিকে ২০২৪ সালের ১৯ মে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আব্দুল্লাহ আল-মামুন সিলেট পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন - কোনো অভিযোগে কাউকে আটকের পর বিচারের আগেই মিডিয়াতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে উপস্থাপন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিচারের আগে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ বন্ধ করা হবে। এটা আইনত বন্ধ থাকার কথা থাকলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কিংবা মামলার প্রেক্ষাপটে যদি কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়; সে ক্ষেত্রে তার ছবি কিংবা তথ্য আদালতে প্রমাণের আগেই গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অথবা পুলিশের ফেসবুক পেজে ছড়িয়ে দেয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে আইনি সেবা দেয়াই পুলিশের দায়িত্ব। মানুষকে অসহায়ত্ব কিংবা অপরাধমূলক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করাই পুলিশের কাজ। যদি পুলিশ নিজেই কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার সুযোগ তৈরি করে তখন পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও অনেকটাই কমে যায়।
এ ক্ষেত্রে পুলিশ অনেক সময় বলার চেষ্টা করে এর মধ্য দিয়ে এ ধরনের ব্যক্তিরা সামাজিকভাবে চাপের মধ্যে থাকে এবং পরবর্তীতে আর অপরাধের সাথে জড়ায় না। বাস্তবে এর সত্যতা খুব বেশি লক্ষ করা যায়নি। তবে উল্টোটাই ঘটছে বেশি। অপরাধ না করেও যখন কেউ সামাজিকভাবে অপরাধের সাজা ভোগ করে, তখন তার মধ্যে প্রতিশোধের মানসিকতাই গড়ে ওঠে।
হাইকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রায়হান বলেন, ‘ফেসবুকের বিষয়ে আলাদা কোনো অর্ডার না থাকলেও মিডিয়া ট্রায়ালের বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগের জাজমেন্ট ছিল। জাজমেন্টে ছিল— গ্রেপ্তার যখন করছেন, বিচার যখন চলছে, নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত একজন মানুষ নির্দোষ। আইনি নীতিগুলো এভাবেই প্রতিষ্ঠিত। যখন কাউকে চোর-ডাকাত উল্লেখ করে কাগজ লিখে, ছবি তুলে কনফারেন্স করে সেটি আসলে স্পেসিফিক আইনকে ভায়োলেশন করে। তাকে সোশ্যালি হেয় করা, মিডিয়া ট্রায়াল করে শাস্তি দেয়ার ঘটনা ঘটে যায়। সেটি না করার জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে হাইকোর্ট বিভাগের।’
তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তাদের ইমেজের কথা বলে। কিন্তু তারা যে সাধারণ মানুষের ইমেজ একদম ভুলুণ্ঠিত করে দিচ্ছে তাদের কাজকর্ম দিয়ে— সেটি দেখভাল করার কেউ নেই। তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এটি পর্যবেক্ষণ করার কথা (বন্ধ করা উচিত), তারা এদিকে মোটেই মনোনিবেশ করছেন না। আমার মনে হয়, যখন পুরোপুরি একটি পুলিশ নির্ভর রাষ্ট্র তৈরি করবেন, তখন পুলিশ এ ধরনের কার্যক্রম করবে। কারণ সে জানে, তার এই কাজকে কেউ চ্যালেঞ্জ করবে না।’
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেছুর রহমান দেশের বিভিন্ন জাতীয় গনমাধ্যমকে বলেন, ‘আসামিদের ছবি প্রকাশ করার কথা নয়। এ নিয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কোনো আসামির ছবিই পুলিশ এভাবে প্রকাশ করতে পারে না। পুলিশ এটি ভুল করছে। কারণ এখানে হাইকোর্ট থেকে তাদের নিষেধ করা আছে, কোনো আসামির ছবি এভাবে দেয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে কেউ যদি দিয়ে থাকে তারা এটি ঠিক করছে না।’ যদিও সারা দেশেই পুলিশের দু’-একটি ইউনিট ব্যতীত প্রায় সব ইউনিটই একই কাজ করে যাচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। যে কারণে কেউ কেউ পুলিশের এ কার্যক্রমের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্টও করছেন।
সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরাও বলছেন, মামলা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মামলা করার অধিকার সবার আছে। আবার তা ফেস করার অধিকারও সবার আছে। মামলা চলাকালীন কেউ অপরাধী নয়। সে কারণে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করার পরও তিনি অপরাধী নন; এটি প্রমাণসাপেক্ষ ব্যাপার। ‘অভিযুক্তদেরও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সে জন্য গ্রেপ্তার করার পরপরই মানুষটিকে অপরাধী সাজিয়ে ক্যামেরার সামনে আনা ও তার প্রচার করা স্পষ্টত মানবাধিকার লঙ্ঘন।
সার্বিক বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশের বিভিন্ন গনমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘হাইকোর্টের নিয়ম না মানলে যে ঘটনা ঘটবে তারা সেটি ফেস করবে। তারা একটি সোর্স পেলেই বক্তব্য দিতে হাজির হয়ে যায়, এগুলো দেখতেছি আমি। মানা করে তো সামলাতে পারছি না। যাদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করছে পুলিশ. তাদের পরিবারেরও সামাজিক মর্যাদাহানি হচ্ছে বলে দাবি করছে আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন মহল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো পুলিশের মহাপরিদর্শককে অবহিত করুন। তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, এগুলো মানা হচ্ছে না, এখন আপনি কি ব্যবস্থা নেবেন ?
পরিশেষে বলতে চাই, মিডিয়া ট্রায়াল কি আদৌ বন্ধ হবে নাকি সামাজিক মাধ্যমে এভাবেই ছবি প্রকাশ হতে থাকবে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
এম.এ.হাবীব জুয়েল
প্রধান সম্পাদক : উত্তরবঙ্গ প্রতিদিন
প্রধান উপদেষ্টা: রাজশাহী পদ্মা প্রেসক্লাব
ব্যুরো প্রধান : দৈনিক মাতৃভূমির খবর (জাতীয় দৈনিক)
অ্যাকটিভিস্ট : অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
ইমেইল :presshabib@gmail.com
প্রকাশক:ফাহমিদা খান, প্রধান সম্পাদক:এম.এ.হাবিব জুয়েল,বার্তা সম্পাদক : রমজান আলী কর্তৃক উত্তরা ক্লিনিক মোড়,উপশহর,বোয়ালিয়া,রাজশাহী-৬২০৩,বাংলাদেশ থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত।বার্তা কক্ষ ০১৭১৫৩০০২৬৫ । ইমেইল: uttorbongoprotidin@gmail.com